Homeপ্রতিবেদন

মুরগির বিষ্ঠায় মাছ চাষ, নিজ খামারের মাছ খায়না মালিকরা, মাছচাষে মুরগির বিষ্ঠার ব্যবহার কমে যাবে- এমন আশা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের

খলিলুর রহমান: কোটি টাকা বিনিয়োগ করে, করেন মাছ চাষ। নিজের খামারের চাষের মাছ খান না, খামারের মালিক ও কর্মচারীরা। বিক্রি করেন বাজারে। খাওয়ান সাধার

বিরূপ পরিস্থিতিতে হতাশ প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস চারপাশে গুমোট পরিস্থিতি সংকট ঘনীভূত, অচলাবস্থা কাটেনি
ভালুকার এম এ ওয়াহেদ ব্রিটিশ সরকারের ওবিই সম্মাননায় ভূষিত
শিক্ষক সংকটে ভুগছে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়

খলিলুর রহমান:

কোটি টাকা বিনিয়োগ করে, করেন মাছ চাষ। নিজের খামারের চাষের মাছ খান না, খামারের মালিক ও কর্মচারীরা। বিক্রি করেন বাজারে। খাওয়ান সাধারণ মানুষকে। চাষের মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করেন, মানব দেহের জন্য মারাতœক ক্ষতিকর মরা-পঁচা মুরগি, মরা মুরগির নাড়িভুড়ি ও মুরগির লিটার। এতে বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুকি। বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে পরিবেশ। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বার বার নিষেধ ও সতর্ক করলেও বিধি-নিষেধ মানছেন না চাষিরা।

আইনকে দেখাচ্ছেন বৃদ্ধাঙ্গলি।

অসহায় সাধারণ মানুষ।

জেনে-না জেনে কষ্টের টাকায় বাজার থেকে মাছ কিনে, খাচ্ছেন বিষ।

মরণ ব্যাধি বহন করছেন নিজ দেহে।

স্বাস্থ্য ঝুকিতে অনাগত প্রজন্মও।

ভয়ঙ্কর এই চিত্র ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার।

নীতিমালা অনুযায়ী, মৎস্য খামার স্থাপনের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে থেকে নিবন্ধন নেবার বিধান থাকলেও উপজেলার বেশির ভাগ মৎস্য খামারেরই নিবন্ধন নেই।

সংশ্লিষ্টরা জানান, মুরগির বিষ্ঠা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এর ক্ষতিকর দিক পাওয়ায় সরকার অনেক আগেই তা নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু অল্প পুঁজিতে বেশি লাভ হওয়ায় অনেকেই মাছ চাষে মুরগি বিষ্ঠা ব্যবহার করছেন।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার হাসান আব্দুল্লাহ আল মাহমুদের কঠোর ভ‚মিকা ও প্রচেষ্টায় মাছ চাষে মুরগির বিষ্ঠা কিছুটা কমলেও মরা-পঁচা মুরগি, মরা মুরগির নাড়িভ‚ড়ির ব্যবহার বেড়েগেছে আশঙ্কাজনত হারে।

দ্রুত বর্ধনশীল হওয়ায় মাছের খাদ্য হিসেবে মুরগির বিষ্ঠার চেয়ে মরা-পঁচা মুরগি, মরা মুরগির নাড়িভূঁড়ির দিকে ঝুকছেন মাছ চাষিরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মরা-পঁচা মুরগি, মরা মুরগির নাড়িভূঁড়ি এনে প্রশাসন ও সাধারণ মানুষের চোখ ফাঁকি দিয়ে মধ্যরাতে মাছের খামারে পানির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়। সূত্রটি জানায়, এই কাজটি রাত-১২টা থেকে ভোর ৪টার মধ্যে তারা করে থাকেন।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, উপজেলার ৬টি ইউনিয়নে ছোট-বড় প্রায় সাড়ে সাত হাজার মৎস্য খামার রয়েছে। এর মাঝে সাড়ে ৭শত খামারের নিবন্ধ আছে। এমন তথ্য উপজেলা মৎস্য অফিসের।

মৎস্য আইন ২০২০ অনুযায়ী মাছের খামারে নিষিদ্ধ ঔষধ, রাসায়নিক ও ক্ষতিকারক পদার্থ ব্যবহার করলে বা মৎস্য খামারে উত্তম মৎস্য চাষ পদ্ধতি অনুসরণ না করলে এটাকে আইনে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এবং ঐ খামার মালিকের অর্থদন্ড সহ কারাদন্ডেরও বিধান রয়েছে।

কিন্তু রস্যজনক ভাবে প্রশাসনের চোখ ফাকি দিয়ে পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পরিবেশে মাছ চাষ হচ্ছে নিয়মিতই।

সরেজমিনে দেখা যায়, জনমানুষের চলাচলের রাস্তার পাশে স্তূপ করে মুরগির বিষ্ঠা ফেলে রাখা হয়েছে পুকুর-বিলে মাছের খাবারের জন্য। ফলে মুরগির বিষ্ঠার দুর্গন্ধে সৃষ্টি হয়েছে এক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের। বাতাসে অসহ্য উৎকট দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ায় আশপাশের মানুষজন নিরুপায় হয়ে পড়েছে। অনেক সময় ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখতে হয়। এমন অভিযোগ মাছের খামারের আশপাশের বসবাসকারী ভ‚ক্তভোগীদের। ভ‚ক্তভোগীরা জানান, মুরগির বিষ্ঠার দুর্গন্ধে তারা অতিষ্ট হয়ে উঠলেও, মাছ চাষিরা রাজনৈতিক ও স্থানীয় ভাবে এতোটাই প্রভাবশালী যে সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করারও সাহাস পায়না।

এদিকে মৎস্য বিজ্ঞানীরা বলছেন, মুরগির বিষ্ঠা দিয়ে উৎপাদিত মাছে রয়েছে মারাত্নক স্বাস্থ্যঝুঁকি। বিষ্ঠা ব্যবহারে পুকুরের পানি, পুকুরের মাটি, মাছ এবং মানবদেহের জন্য মারাত্নক ক্ষতিকর। এছাড়া মুরগির বিষ্ঠায় অনেক জীবাণু থাকায় মাছের রোগবালাই বেড়ে যায়। এতেকরে অনেক সময় মাছ চাষিরাও ক্ষতির শিকার হয়।

খোঁজনিয়ে জানাগেছে, মাছের খামারের সঙ্গে কেউ কেই মুরগির খামারও গড়ে তুলেছেন। পুকুর অথবা বিলের মাঝখানে অথবা পাশেই মুরগির খামার। মুরগির বিষ্ঠা ও অন্যান্য আবর্জনা ধুয়ে সরাসরি পুকুর-বিলে ফেলে দিচ্ছে। সেসব আবর্জনা মাছের খামারে যাচ্ছে মাছের খাদ্য হিসেবে।

মৎস্য বিজ্ঞানীরা জানান, মুরগির রোগবালাই নিয়ন্ত্রণে অনেক সময় উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। আর সেসব অ্যান্টিবায়োটিকের একটা অংশ লম্বা সময় মুরগির দেহে ও বিষ্ঠায় থেকে যায়। সেসব বিষ্ঠা মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করলে, আমরা যে মাছ খাচ্ছি সেই মাছের মাধ্যমে মানুষের শরীরে ঢুকে পড়ে। অনেক হেভি মেটাল মানবদেহে প্রবেশের ফলে হার্ট, কিডনি, লিভারের ক্ষতি হতে পারে, হতে পারে মারাতœক ধরনের চর্মরোগও।

ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. মুশফিকুর রহমান বলেন, মুরগির বিষ্ঠা মাছের শরীরে প্রবেশ করলে তা সহজে ধ্বংস হয় না। তাই এগুলো মাছের মাধ্যমে পরবর্তীতে মানবদেহে প্রবেশ করলে ক্যান্সারসহ মারাত্নক রোগ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে শিশুস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্নক এক হুমকি।

উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, মাছের খাদ্য হিসেবে মরা মুরগির নাড়িভুঁড়ি ও মুরগির বিষ্ঠা ব্যবহারের কোন সুযোগ নেই। তিনি জানান, উপজেলা প্রশাসন কঠোর ভূমিকায় মাছ চাষে মুরগির বিষ্ঠা কিছুটা কমে এসেছে এবং অচিরেই তা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাবে।

সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সাইদুর রহমান জানান, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাছের খামার গুলিতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। মাছের খাদ্য হিসেবে নিষিদ্ধ মুরগির বিষ্ঠা ব্যবহার কারিদের আইনের আওতায় আনা হবে।

ইতিমধ্যে কয়েকটি খামারে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করেন উপজেলা প্রশাসন।

কয়েকটি মাছের খামারে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করতে গিয়ে অভিজ্ঞতার বর্ণনাদিয়ে সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইকবাল হোসাইন বলেন, সরেজমিনে দেখলাম শত শত মাছের খামারে মুরগির লিটার, মরা মুগির নাড়িভুড়ি পুকুরে ফেলে রাখা হয়েছে মাছের খাবারের জন্য। এই সময় খামারের কর্মচারীদের জিজ্ঞেশ করি এই মাছ খামারের মালিক বা তারা নিজেরা খায় কিনা? কর্মচারীরা জানায়, মালিক ও তারা নিজেরা এই মাছ খায়না। এই সব মাছ বাজারে বিক্রি করেন। প্রশ্ন করি, যে মাছ তারা নিজেরা খায়না সেটা বাজারে বিক্রি করে সাধারণ মানুষকে খাওয়ান কেমনে? এমন প্রশ্নের কোন উত্তর কর্মচারীরা দিতে পারেনি।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার হাসান আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ জানান, বিভিন্ন অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমরা বিষয়টি আমলে নেই এবং সমস্যাটি চিহ্নিত করি। দেখলাম যে, মুরগির বিষ্ঠা উৎপাদন বন্ধ করতে না পারলে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কয়েকটি হ্যাচারিকে সতর্ক করা হয়ছে এবং মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জরিমানা করা হয়। এরপর আমি ব্যক্তিগত ভাবে সিপির ম্যানেজম্যান্ট এর সাথে কথা বলি এবং তাদেরকে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপনে উদ্ধুদ্ধ করি, তারাও সম্মতি প্রকাশ করে। বায়োগ্যাস প্লান্ট নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। চলতি বছরের নভেম্বরে সিপি বায়োগ্যাস প্লান্ট উৎপাদনে যাবে। আশা করছি এরপর মাছচাষে মুরগির বিষ্ঠার ব্যবহার শতভাগ কমে যাবে।

COMMENTS

WORDPRESS: 0
DISQUS: