বাকৃবি সংবাদদাতা: দেশে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে বেড়েছে বালাইনাশক বা কীটনাশকের ব্যবহার। ক্ষুদ্র কৃষক থেকে বড় উদ্যোক্তা পর্যন্ত ফসলের রোগ সৃষ্টিকা

বাকৃবি সংবাদদাতা:
দেশে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে বেড়েছে বালাইনাশক বা কীটনাশকের ব্যবহার। ক্ষুদ্র কৃষক থেকে বড় উদ্যোক্তা পর্যন্ত ফসলের রোগ সৃষ্টিকারী পোকা নিধনে অনিয়ন্ত্রিতভাবে কীটনাশক ব্যবহার করছেন। যার সরাসরি প্রভাব ফেলছে কৃষক, ভোক্তা ও পরিবেশের ওপর। ফলে ক্যান্সারসহ নানা দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন কৃষকরা। স¤প্রতি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কীটতত্ত¡ বিভাগের অধ্যাপক ড. গোপাল দাস ও তাঁর গবেষক দল দেশে প্রথমবারের মতো ‘অধিক বিপদজনক বালাইনাশক’ চিহ্নিত করছেন। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাবিøউএইচও) নির্ধারিত ৮টি আন্তর্জাতিক মানদÐ অনুসরণ করে দেশে নিবন্ধিত ৩৪৩টি সক্রিয় উপাদান বিশ্লেষণ করে মোট ২৫টি অধিক বিপদজনক বালাইনাশক চিহ্নিত করে গবেষকদল। এই ২৫টি বালাইনাশকের মধ্যে ১১টি কীটনাশক, ৭টি ছত্রাকনাশক, ৫টি আগাছানাশক এবং ২টি ইঁদুরনাশক।
এর আওতায় প্রায় ৮ হাজার বাণিজ্যিক পণ্যে এসব উপাদানে ব্যবহৃত হয়। বুধবার (৩০ জুলাই) দুপুরে ঢাকায় অবস্থিত তুলা ভবনের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত “বাংলাদেশে অধিক বিপদজনক বালাইনাশক (ঐঐচং) ও রাসায়নিকের উন্নত ব্যবস্থাপনার জন্য সক্ষমতা বৃদ্ধিমূলক” শীর্ষক কর্মশালায় গবেষণাটি সম্পর্কে এসব তথ্য তুলে ধরেন প্রধান গবেষক অধ্যাপক ড. গোপাল দাস।গবেষণায় দেখা গেছে, মাঠপর্যায়ে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ৯টি অধিক বিপদজনক বালাইনাশক হলো-এবামেকটিন, ক্লোরপাইরিফস, প্যারাকুয়াট, গ্লাইফোসেট, গ্লুফোসিনেট অ্যামোনিয়াম, কার্বেন্ডাজিম, প্রোপিকোনাজোল, জিঙ্ক ফসফাইড ও ব্রোমাডিওলন। এছাড়া আরও কিছু বালাইনাশকের মধ্যম বা সীমিত ব্যবহার দেখা গেছে। অন্যদিকে, সাইফ্লুথ্রিন, বিটা-সাইফ্লুথ্রিন, ট্রায়াজোফস, এডিফেনফস, ফ্লুলসিলাজোল নামক বালাইনাশকের তেমন কোনো মাঠ পর্যায়ে ব্যবহার পাওয়া যায়নি, যা এখনই নিষিদ্ধ করা সম্ভব বলে মত দেন গবেষকগণ।
এসব বালাইনাশকের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে ড. গোপাল জানান, ‘এগুলো মানবদেহে ক্যান্সার, কিডনি বিকলতা, হৃদরোগ, ফুসফুসের জটিলতা এমনকি প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলে। শুধু মানুষ নয়, প্রাণীক‚ল এবং পরিবেশেও দীর্ঘস্থায়ী বিষক্রিয়া তৈরি করে। এসব বালাইনাশকের একটি বড় অংশ স্থায়ী জৈব দূষক হিসেবে পরিবেশে জমে থাকে বছরের পর বছর।’
গবেষণা শেষে ড. গোপাল দাসের নেতৃত্বে দেশব্যাপী ১৪টি অঞ্চলে দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ, র্যালি, মাঠ প্রদর্শনী ও ১০টি আঞ্চলিক কর্মশালা আয়োজন করা হয়। কৃষক, বালাইনাশক ডিলার ও কৃষি কর্মকর্তাদের সচেতন করতে নেয়া হয় কার্যকর উদ্যোগ।
গবেষক ড. গোপাল দাস আরও জানান, ‘সরকারি মহলে এখন যা করা দরকার তা হলো- অধিক বিপদজনক বালাইনাশকের রেজিস্ট্রেশন বাতিল বা নবায়ন বন্ধ করতে হবে। বিকল্প নিরাপদ বালাইনাশক ব্যবহারে প্রশিক্ষণ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি ডিলারদের লাইসেন্স কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
এছাড়াও কৃষি কর্মকর্তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। সেই সাথে মাঠ পর্যায়ে বর্তমান আইন বাস্তবায়ন করতে পারলে এই ক্ষতির হাত থেকে দেশের কৃষক ও কৃষি খাতকে রক্ষা করা সম্ভব।’ অধিক বিপদজনক বালাইনাশকের এই চিহ্নিতকরণ ও সুনির্দিষ্ট সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশে টেকসই কৃষি, নিরাপদ খাদ্য ও স্বাস্থ্যকর ভবিষ্যতের দিকেই এগিয়ে যাবে বলে আশাবাদী বাকৃবির এই গবেষক।
বাকৃবির কীটতত্ত¡ বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. মো. মাহবুবুর রহমানের সভাপতিত্বে কর্মশালায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলে কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. সাইফুল আলম। সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) বাংলাদেশ অঞ্চলের জ্যোষ্ঠ কারিগরি ও নীতি উপদেষ্টা মারটিজিন ভন দে গ্রোয়েপ। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ডিএই’র প্লান্ট কোয়ারেন্টাইন উইংয়ের পরিচালক মো. আব্দুর রহিম, বাকৃবি রিসার্চ সিস্টেমের (বাউরেস) পরিচালক অধ্যাপক ড. এম. হাম্মাদুর রহমান। কর্মশালায় স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন বাকৃবির কৃষিতত্ত¡ বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষকদলের সদস্য অধ্যাপক ড. মো. রমিজ উদ্দিন।
এছাড়াও দেশের কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিজ্ঞানীগণ, ডিএই কর্মকর্তাবৃন্দ, বিভিন্ন কীটনাশক কোম্পানির প্রতিনিধি, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক, কৃষক ও আমন্ত্রিত অতিথিরা এসময় উপস্থিত ছিলেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) মহাপরিচালক মো. সাইফুল আলম বলেন, ‘আমরা বর্তমান প্রচলিত বালাইনাশক আইনের সংস্কারের লক্ষ্যে কাজ করছি, যাতে জনগণকে নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা দিতে পারি। তবে আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যা আমরা অকপটে স্বীকার করি। এ সমস্যা সমাধানে শিক্ষক, গবেষক ও নীতিনির্ধারকদের একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি আরও বলেন, ‘ক্ষতিকর কীটনাশকের অতি ব্যবহারের ফলে জনস্বাস্থ্যের উপর গুরুতর প্রভাব পড়ছে। এগুলো ক্যান্সারের মতো প্রাণঘাতী রোগ সৃষ্টি করতে পারে। তাই এসব বালাইনাশকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য আমরা ২০২৫ সালে একটি নতুন আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছি। আমরা অবশ্যই খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে চাই, তবে তা যেন পরিবেশের ক্ষতি করে না হয়, সেদিকে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। এজন্য জৈব কীটনাশক ও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতির ব্যবহার বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করছি।
COMMENTS